(দাবি আদায়ের কর্মসূচির কারণে রাজধানীর মানুষ আরও বেশি দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে তারা কখন এবং কীভাবে মুক্তি পাবেন, তার কোনো দিশা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার পরও এসব আন্দোলন থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।)
শের ই গুল :
আন্দোলন-কর্মসূচির আরও একটি দিক বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হলো, কোনো একটি মহলের দাবি আদায়ের কর্মসূচির নিরসন হলে, অন্য আরেকটি মহল থেকে অন্য দাবি নিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করা হয়। একইভাবে একটি শেষ হলে শুরু হয় আরেকটি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, কোনো এক পক্ষ তাদের দাবি আদায় করতে পারলে, তা অনুসরণ করে অন্যরাও দাবি আদায়ের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছেন। এভাবেই দাবি আদায়ের আন্দোলন-কর্মসূচি এক মহল থেকে আরেক মহলে চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। দাবি আদায়ের এ প্রক্রিয়াকে একটি অবিচ্ছিন্ন শিকলবেষ্টিত বৃত্ত হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যে বৃত্তের বেড়াজালে বন্দি হয়ে আছে দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা। এর ফলস্বরূপ, দুর্ভোগের হাত থেকে দেশবাসীর মুক্তি মিলছে না। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ধারাবাহিকভাবে অবনতির দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কোনো কোনো মহল সক্রিয় রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে।
একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে বিভিন্ন মহলের দাবি নিয়ে নিত্যদিনের কর্মসূচির নামে রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকার বিভিন্ন সড়ক অবরোধের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগে পড়ে জনসাধারণ এখন এক ধরনের অস্থির সময় পার করছেন। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে এখন আর শৃঙ্খলা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ভেতরে ভেতরে জনঅসন্তোষ তৈরি হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এর সঙ্গে নানামুখী গুজব তো রয়েছেই! সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলাফেরা না করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সড়ক-শৃঙ্খলা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর উচ্চমূল্য নিয়ে জনঅসন্তোষের দিকটি টের পাওয়া যায় না। নিুআয়ের মানুষের সঙ্গে না মিশে তাদের মনের ভেতরে জমে থাকা দুঃখের কথাগুলো পড়া যায় না। এটা স্পষ্ট, কার্যত অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা দেখার জন্য অনেকেই অতি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে! এ দিকটি যে অন্তর্বর্তী সরকারের নজরে নেই, তা নয়। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, বিচিত্র আন্দোলন নিয়ে সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকেই তৈরি হয়ে আছে; যদিও এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ এ দেশে সুযোগসন্ধানী ও স্বার্থান্বেষী মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়!
নানামুখী দাবি আদায়ের জন্য বর্তমানে দেশে যে ধরনের আন্দোলন-কর্মসূচি চলছে, এ রকম দুনিয়ার আর কোথাও দেখা যায় না। বিভিন্ন মহলের উত্থাপিত দাবিগুলো যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক, যা-ই হোক না কেন, দাবি আদায় করতে গিয়ে দেশের মানুষকে বিশেষ করে রাজধানীবাসীকে যেভাবে জিম্মি করা হচ্ছে, এটাও অন্য কোনো দেশে ঘটে না। যারা দাবি উত্থাপন করছেন, তারা রাস্তাঘাট দখল করে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন। এর ফলে নিত্যদিন সড়কে যানবাহন চলাচল এক ধরনের স্থবির হয়ে পড়ছে, সাধারণ কিংবা অসাধারণ-উভয় শ্রেণির নাগরিক চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এ দিকটি দাবি উত্থাপনকারীরা কখনো ভেবে দেখেন বলে মনে হয় না। এমনিতেই রাজধানীতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে যে বিপুলসংখ্যক যানবাহন চলাচল করে, তাতে কোনো সড়কই যানজটমুক্ত থাকে না। রাজধানীতে অনেক উড়াল সড়ক থাকার পরও প্রতিদিন কোনো না কোনো আন্দোলনের কারণে ছোট-বড় সব সড়কে প্রায়শই যানজট লেগে থাকে। অসহনীয় যানজটে সব থেকে বেশি দুর্ভোগের শিকার হন বয়স্ক, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিরা। যানজটে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা সবসময় এক ধরনের মানসিক চাপের মুখে থাকেন। এক কথায়, দাবি আদায়ের কর্মসূচির কারণে রাজধানীর মানুষ আরও বেশি দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে তারা কখন এবং কীভাবে মুক্তি পাবেন, তার কোনো দিশা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার পরও এসব আন্দোলন থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমনও লক্ষ করা গেছে, দাবি আদায়ের দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীরা একরকম বিনা বাধায় রাষ্ট্রপরিচালনার কেন্দ্রস্থল সচিবালয়ে প্রবেশ করে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। একপর্যায়ে সার্বিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে যানজট এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন মহল কারণে-অকারণে নানা ধরনের দাবি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছে। দাবি আদায়ের জন্য দেশ যেন এখন এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাত্রা আগের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরতদের অনেকেই সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলেন-এ ধরনের বক্তব্য দাঁড় করিয়ে নিজেদের দাবিও পূরণ করে নিয়েছেন। গার্মেন্ট খাতে তো দাবি আদায়ের জন্য এক ধরনের লাগাতার কর্মসূচি চলছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের অন্যতম দাবি, সময়মতো তাদের বেতন পরিশোধ করা হয় না; ফলে তারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। অথচ গার্মেন্ট শিল্পের মালিক, শ্রমিক ও সরকার মিলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মাধ্যমে শ্রমিকদের বহু দাবি মেনে নেওয়ার পরও শ্রমঅসন্তোষ পুরোপুরি কাটানো সম্ভব হচ্ছে না। এসবের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করলে এ ধারণাই জোরালো হয়, একদিকে যথাযথ প্রতিশ্রুতি দিয়েও শুধু রাষ্ট্রে অসন্তোষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো কোনো গার্মেন্ট কারখানার মালিকপক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা হয়; এ কারণে শ্রমিকরা বারবার বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। আবার অনেক যৌক্তিক দাবি পূরণের পরও কিছু কিছু গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিক শুধু অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বারবার একের পর এক উদ্ভট দাবি উত্থাপন করছেন। এটা যে সাধারণ জনগণ বুঝতে পারেন না, তা নয়। এ অবস্থায় দেশের গার্মেন্ট খাতকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে একরকম অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে। অন্যদিকে শ্রমিকদের বিক্ষোভ-আন্দোলনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো ঢাকা মহানগরীর ওপর। এর ফলে জনজীবন একরকম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি কাম্য নয় কিছুতেই।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, রাষ্ট্রপরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর একবার এক উপদেষ্টা চারদিকে দাবি আদায়ের আন্দোলন-সমাবেশ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘ধান কাটার মৌসুমের মতো দাবি আদায়ের মৌসুম শুরু হয়েছে।’ দাবি আদায়ের বিরতিহীন কর্মসূচি নিয়ে উপদেষ্টার এ মন্তব্য থেকেই বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করা যায়। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের একশত দিন অতিক্রম হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন মহলের নানামুখী দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন মহলের অন্তহীন দাবি-দাওয়া পূরণ করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মূল উদ্দেশ্য থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের দাবি আদায়ের কর্মসূচি নিয়ে দেশে যে ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে সামনের দিনগুলোয় দেশ এক মহাসংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান টার্গেট হলো, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরিহার্য সংস্কার শেষে যত দ্রুত সম্ভব একটি শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা এবং ওই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্য দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ লক্ষ্য নিয়ে সরকার এগিয়ে গেলেও, বিভিন্ন মহলের নানা ধরনের দাবি আদায়ের বহুমুখী আন্দোলন ও কর্মসূচির ফলে সৃষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি দেখে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার ও সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা করা ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। এ পরিস্থিতি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে, সামনে আমাদের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করবে, এটা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।