(বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মী এবং পুলিশের নামে চার শতাধিক মামলা হয়েছে আদালত ও দেশের বিভিন্ন থানায়। এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে। অজ্ঞাত পরিচয় আসামি দুই লাখের মতো। এই মামলাগুলোর আসামি, অপরাধের ধরন, এজাহার ও অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আরও যে একটি বিষয় উঠে এসেছে তা হলো-এসব মামলাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেটের নীরব চাঁদাবাজির অপতৎপরতা)
শের ই গুল :
মামলা থেকে নাম (এজাহারে থাকুক বা না থাকুক) কাটিয়ে দেওয়ার নামে চলছে এই চাঁদাবাজি। নানা ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন এই চক্রের ধুরন্ধর সদস্যরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়কার ঘটনাবলি এবং বিগত সরকারের আমলের নানা ইস্যুতে এসব মামলা হচ্ছে অনেকে ভুক্তভোগী দাবি করে মামলা করছেন, কোথাও আবার বাদী হচ্ছেন স্বজনরা। এমনও মামলা হচ্ছে- যেখানে ভুক্তভোগী নিজে বা তার পরিবারের কোনো সদস্য বাদী হচ্ছেন না, হচ্ছেন পূর্বপরিচিত দাবি করে কেউ কেউ।
সারা দেশ থেকে এ বিষয়ে খবর মিলছে। প্রাণের বাংলাদেশের প্রতিবেদকদের পাঠানো কয়েকটি এলাকার খবর তুলে ধরা হলো—
বরিশাল : বরিশাল মহানগর বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়ার অভিযোগে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান। গত ২৩ আগস্ট দায়ের হওয়া সেই মামলায় আসামি হওয়ার খবর পান বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার এক সাবেক ইউপি সদস্য। আসামির তালিকা থেকে নাম কাটানোর প্রস্তাব দিয়ে তাকে ফোন করেন উপজেলার সাবেক এক ছাত্রদল নেতা। বিনিময়ে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ইউপি সদস্য জানান, গত এক বছর ধরে তিনি এলাকায় যান না। আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও বর্তমানে ঢাকায় ব্যবসা করেন। গত ২৫ আগস্ট বানারীপাড়ার সাবেক এক ছাত্রদল নেতা তাকে ফোন করে জানান, বরিশাল মহানগর বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। টাকা দিলে নাম কাটিয়ে দেবেন। পরে পরিচিত এক অ্যাডভোকেটের মাধ্যমে জানতে পারেন, এজাহারে তার নামই নেই। এ বিষয়ে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। যদি কেউ প্রমাণসহ যোগাযোগ করতে পারেন, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মামলা নিয়ে এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে বরিশালের ১০ উপজেলা ও মহানগরীতে। কোন মামলায় কে আসামি হবেন, কাকে বাদ রাখা হবে তাও ঠিক করা হয় মিটিং করে। অভিযোগ আছে, চাঁদা না দিলে যে কাউকেই ফাঁসানো হচ্ছে মিথ্যা মামলায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ভুক্তভোগী জানান, জায়গাজমি নিয়ে বিরোধ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে একদল সুবিধাবাদী এসব করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি কোনো অপকর্ম করে তো সে যে-ই হোক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেন, প্রতিটি মামলা তদন্ত করা হবে। নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানির কোনো সুযোগ নেই।
বগুড়া : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বগুড়াতেও মামলার হিড়িক পড়েছে। সেখানে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার পাশাপাশি স্থানীয় নেতাদের নামে থানা ও আদালতে হত্যা, গুম ও অপহরণের অভিযোগে মামলা হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি কোটাবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও মামলা করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দলীয় পরিচয়ে এবং নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত বগুড়ার বিভিন্ন থানা ও আদালতে অন্তত ২৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা দায়ের করার আগে আসামি করার হুমকি দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। তবে বিপদ না বাড়াতে ভুক্তভোগীদের কেউ এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে নারাজ।
সারিয়াকান্দিতে আসামির তালিকা থেকে নাম কাটানোর কথা বলে আহসান হাবিব নামে এক স্কুলশিক্ষকের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে স্থানীয় কয়েকজন ছাত্রদল নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ওই চাঁদাবাজির শিকার আহসান হাবিব এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি ভিডিও বক্তব্য দেন। অভিযোগ হচ্ছে— তাকে বলা হয় যে, সাব্বির, বাবুল, মজনু নামে ছাত্রদলের তিন সদস্য তার বিরুদ্ধে মামলা করছেন। মামলা থেকে নাম কাটাতে হলে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হবে। তাদের চাপাচাপিতে আহসান হাবিব ২০ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহসান হাবিব বলেন, ‘মিটমাট হয়েছে। এটা নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।’
সারিয়াকান্দি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, উপজেলা ছাত্রদলের দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাবুল ও নিপ্পন মণ্ডল স্কুলশিক্ষক আহসান হাবিবের কাছ থেকে মামলায় আসামি করার হুমকি দিয়ে টাকা নিয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। ওই ঘটনায় জড়িত সাব্বির একজন ছাত্রদল কর্মী। এসব অপকর্মের কারণে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
চট্টগ্রাম : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে চট্টগ্রামে চলছে মামলা দায়েরের উৎসব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সহিংসতা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা দুর্নীতির ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করেছেন। মামলায় আসামি করা নিয়ে নীরব চাঁদাবাজিও চালাচ্ছে একটি চক্র। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও এর সঙ্গে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতারণার এমন একটি ঘটনা ধরা পড়ে গত ২০ আগস্ট রাতে। এই প্রতিবেদককে ফোন করেন আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা। যিনি জনপ্রতিনিধিও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভাই, কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় আমাকে জড়ানো হচ্ছিল। মামলার অভিযোগ থেকে নাম বাদ দিতে দুই লাখ টাকা চেয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক পরিচয়ে একজন ফোন করে বলেছেন তার সঙ্গে দেখা করতে। আমি ভয় পাচ্ছি বলে জানালে তিনি বলেছেন, একাধিক বিকাশ নম্বরে ভাগ করে দুই লাখ টাকা পাঠাতে। শেষ পর্যন্ত আমি কিছু টাকা দিয়েছি। এ বিষয়ে পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে নামটি বলা হয়েছে, সেই নামে কোনো সদস্য কোতোয়ালি থানায় নেই।
এর দুদিন পর অভিযোগ করেন আরেক আওয়ামী লীগ নেতা। পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলায় নাকি তাকে জড়ানো হচ্ছে। থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মামলার বিষয়টিই সঠিক নয়। এভাবে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে একটি চক্র। ভয়ে নেতারা থানা পুলিশকে জানাচ্ছেন না। পরিচিতদের মাধ্যমে থানায় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বিকাশে টাকা দিচ্ছেন।
অভিযোগের কপি থেকে নাম বাদ দিতে টাকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের একজন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অভিযোগের একটা লিখিত কপি পাঠিয়ে একজন ফোন করে বললেন, ৫০ হাজার টাকা দিলে নাম বাদ দেবেন। আমি ২০ হাজার টাকা দিলে নাম বাদ দেওয়া হয়।’
প্রাণের বাংলাদেশের কাছে চাঁদাবাজি নিয়ে কথোপকথনের একটি কল রেকর্ডও এসেছে। যেখানে একজন ছাত্রলীগ কর্মীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কখনও ওয়ার্ড পর্যায়ের কোনো পদের জন্য সিভি জমা দিয়েছিলেন কিনা? দিয়েছিলেন বলার পর তাকে বলা হয়, সদরঘাট থানায় যদি তোমার এই সিভিটা দিয়ে আসি কতগুলো মামলার আসামি হবে জান? তখন ওই ছাত্রলীগ সদস্য শুধু দলকে সমর্থন করা ছাড়া কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না জানিয়ে এমন কিছু না করতে অনুরোধ করেন। একপর্যায়ে ওই প্রান্ত থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২৫ হাজার টাকায় রফা হয়।
এর বাইরে আদালতকে ঘিরে আইনজীবীদের একটি চক্রও একধরনের চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট তৈরি করেছে বলে দাবি করেছেন ছাত্রদলের একজন নেতা। তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের একটি চক্র আছে। তারা যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে এজাহার বানায়। সেখানে ২০০-৩০০ আসামি রাখে। এরপর কয়েক দিন সেই খসড়া তালিকা আসামিদের কাছে পাঠায় এবং নাম কাটানোর কথা বলে অনেকের কাছ থেকেই টাকা আদায় করে। দেখা যায়, এভাবে শেষ পর্যন্ত তালিকায় নামের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় অর্ধেকে আসার পর মামলা হয়।
খুলনা : সরকার পতনের পর খুলনায় হামলা ও মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবির ঘটনাও থেমে নেই। এরই মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর, দৌলতপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ খালিদ আহমেদের সঙ্গে বিএনপির দুই নেতার চাঁদা দাবির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তিকে ম্যানেজ করার কথা বলে লাখ দুয়েক টাকা চাঁদা চাওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই বিএনপি নেতা হলেন- ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শেখ রিয়াজ শাহেদ ও খুলনা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম হোসেন। তবে দুই নেতাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া চাঁদা দাবির ভিডিওটি এডিট করা এবং ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন।
খুলনা মহানগর ও জেলার ৯টি উপজেলাতেই চলছে হামলা ও মামলার নামে ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির ঘটনা। তবে সবকিছুই চলে গোপনে। অনেক সময় জানাজানি হলেও কেউই স্বীকার করছেন না। মহানগরীর একাধিক মিষ্টি ব্যবসায়ী জানান, তাদের আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে ভয়ভীতি দেখিয়ে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর বড়বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী, সোনার ব্যবসায়ী, ডেভেলপার কোম্পানি ও প্লট ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিকারকসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম আসছে।
খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা ও সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বিবৃতি দিয়ে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদা দাবি করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে এবং বিএনপির অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে।
রাজশাহী : রাজশাহী মহানগর ও জেলা পুলিশের ২০টি থানা এবং আদালতসমূহে আওয়ামী লীগের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অন্তত অর্ধশত মামলা হয়েছে। কিছু মামলায় নাম কাটাতে একটি চক্র চাঁদাবাজি শুরু করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর নগরীর শিরোইল এলাকায় আওয়ামী লীগের এক নেতার কাছে ফোন করে তার নামে আদালতে মামলা হচ্ছে এবং সেই মামলায় আসামি হিসেবে নাম আসছে জানিয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। বলা হয়, টাকা দিলে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে। সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা দিতে রাজি হন ওই নেতা। শেষপর্যন্ত এজাহারে নাম আসে ওই নেতার।
একই ধরনের অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপির তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী। তার ভাষ্য, ক্ষমতার পালাবদলের পর একটি চক্র তার কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাকেও মামলার আসামি করা হয়েছে। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে কখনও যুক্ত ছিলেন না। মামলার বাদীকেও তিনি চেনেন না।
গত ৫ আগস্ট নগরীর তালাইমারিতে আন্দোলন চলাকালে সাকিব আঞ্জুম ও আলী রায়হান নামে দুজন ছাত্র নিহত হন। মহানগর যুবলীগের এক নেতা বলেন, ওই ঘটনায় যাদের নামে মামলা দেওয়া হবে তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। যারা পলাতক, তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অথবা পরিবার ও বন্ধুদের মাধ্যমে খবর দেওয়া হচ্ছে। মামলা থেকে নাম বাদ দিতে দাবি করা হচ্ছে টাকা। বাদীকেও উস্কে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি নাম সংযুক্ত করতে।
বোয়ালিয়া থানার ওসি মাসুদ পারভেজ বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ থাকায় সব অভিযোগই গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে নির্দোষ ব্যক্তিদের ভয়ের কিছু নেই। তদন্ত শেষে শুধু আসল অপরাধীদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট হবে।
রংপুর : রংপুরেও দেদার মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত-নিহতের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করে মামলা হচ্ছে। আসামি করা হচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতা, জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যসহ অনেক সাধারণ মানুষকেও। আন্দোলনের সময় অনেকে বিদেশে থেকেও মামলার আসামি হয়েছেন। অনেক আওয়ামী লীগ নেতার ফোনে মামলার হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। বেশিরভাগ মামলার ক্ষেত্রে কাদের আসামি কারা হয়েছে তা জানেন না বাদী নিজেও। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ব্যক্তিরা বাদীকে প্রভাবিত করে এসব মামলা করাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মামলা করার ক্ষেত্রে বাদীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার তথ্যও মিলেছে।
রংপুর গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বাসিন্দা ব্যারিস্টার মঞ্জুম আলী আন্দোলনের আগে তার কর্মক্ষেত্র লন্ডনে চলে যান। তার ছোট ভাই লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদীর কাছে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়। না হলে মামলায় তাদের দুই ভাইয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানানো হয়। হাদী দেখা করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর একটি মামলায় লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার মঞ্জুম আলীকে ৩ নম্বর ও হাদীকে ৪২ নম্বর আসামি করা হয়েছে।
গত ১৯ জুলাই রংপুর সিটি করপোরেশনের সামনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারান আবেদুল ইসলাম আবেদ। গত ৩ সেপ্টেম্বর আবেদের বাবা নুরুল হক বাদী হয়ে ৫৯ জনের নামে মামলা করেন। এতে অজ্ঞাত আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়।
নুরুল হক জানান, মামলা না হলে পরবর্তীকালে সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যাবে না— এমন কথা শুনে স্থানীয় কাউন্সিলরের সহযোগিতায় তিনি মামলা করেন। আসামি কারা সেটা তিনি জানেন না। শুধু আদালতে গিয়ে কাগজে সই করে এসেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ফল বিক্রেতা মেরাজুলের মা আম্বিয়া বেগম বলেন, তার করা মামলার এজাহারে থাকা আসামিদের বিষয়ে তিনিও কিছু জানেন না।
আন্দোলনে নিহত রংপুরের স্বর্ণের দোকানের শ্রমিক মিলন হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে আছেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার ও সাবেক জেলা প্রশাসক। নিহতের ছেলে বায়েজিদ হোসেন বলেন, তার বাবার হত্যার ঘটনায় মা বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় ভুলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির কিছু নেতাকর্মী ব্যক্তিগত আক্রোশ ও মামলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাদীকে ভুল বুঝিয়ে বিভিন্ন জনকে এ মামলায় জড়িয়েছেন।
মামলা বাণিজ্য নিয়ে রংপুরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ইমরান আহমেদ বলেন, রংপুরে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবার আদালতে মামলা করছে। অনেকে চাপে পড়ে কিছু নিরপরাধ ব্যক্তির নাম যোগ করেছেন। অর্থ ও বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের প্রভাবিত করেছে একটি গোষ্ঠী, যা দেশের সুশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রংপুর জজকোর্টের আইনজীবী রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, আবু সাঈদ হত্যা মামলা ছাড়া অন্য আহত-নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে করা মামলায় সঠিক আসামিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ ও স্বার্থ চরিতার্থ করা হয়েছে।
রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, ছাত্র-জনতার বিজয়কে ম্লান করতে বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের ভুয়া পরিচয় দিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল চাঁদাবাজি করছে। এসব বন্ধে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কেউ বিএনপির নামে চাঁদাবাজি কিংবা মামলার ভয় দেখালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রমতে, ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মী এবং পুলিশের নামে চার শতাধিক মামলা হয়েছে আদালত ও দেশের বিভিন্ন থানায়। এসব মামলায় নাম প্রকাশ করে আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে। অজ্ঞাত পরিচয় আসামি দুই লাখের মতো। এই মামলাগুলোর আসামি, অপরাধের ধরন, এজাহার ও অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আরও যে একটি বিষয় উঠে এসেছে তা হলো— এসব মামলাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেটের নীরব চাঁদাবাজির অপতৎপরতা। বিশেষ করে এজাহারে যাদের নাম নেই, তাদের শনাক্ত করতে চক্রটি পুলিশের চাইতেও কয়েক ধাপ এগিয়ে। এই সিন্ডিকেটের অপরাধমূলক নানান কর্মকাণ্ড নিয়ে সারা দেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে বিস্তর অভিযোগ।