মোঃ শামছুল হক-শেরপুর :
বাংলাদেশ থেকে এশিয়ান প্রজাতির হাতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তের পথে চলে আসছে বলে হাতি গবেষকরা জানালেও শেরপুরে আশার আলো জেগেছে। এখানে গত এক বছরে প্রায় অর্ধশত নতুন হাতির শাবকের জন্ম হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে দিন দিন হাতির সংখ্যা বাড়ছে বলে বন বিভাগের একটি সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ ২২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পেছনের জঙ্গলে একটি হাতি শাবকের জন্ম হয়। এর দুই তিন মাস আগেও এই জঙ্গলে আরো কয়েকটি হাতি শাবকের জন্ম হয়েছে বলে স্থানীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া জানায়।
বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া আরো বলেন, আমার এই রেঞ্জে বেশ কিছু এলাকায় গভীর বন থাকায় এখানে প্রায় তিনটি দলে বিরক্ত হয়ে হাতির দল বিচরণ করে আসছে। এই তিনটি দলে ৩০ থেকে ৩৫টি করে হাতি রয়েছে। সেই সাথে প্রতিটা দলে ৭ থেকে ৮টি হাতি শাবক দেখা যায়। বৃহস্পতিবার রাতে বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পাশেই জন্ম নেওয়া হাতি শাবক এখন সুস্থ আছে এবং দলবদ্ধ হয়ে মা হাতির সাথে বনের ভেতরে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
ওই রেঞ্জ কর্মকর্তা আরো জানান, সম্প্রতি আমাদের বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথ সভায় হাতি রক্ষায় এবং জানমালের ক্ষতি রক্ষায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষ হাতির উপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকছে। সেই সাথে তাদের ফসল বাঁচাতেও হাতির উপর হামলা না চালিয়ে বন বিভাগের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন থেকে শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড় এলাকায় হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এতে করে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি চলছে হাতি হত্যাও। স্থানীয় কৃষকরা তাদের ফসল বাঁচাতে জমির চারপাশে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে রাখেন যেন হাতির এসে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু এতে বিদ্যুতায়িত মারা পড়ছে নিরীহ বন্য হাতি।
সর্বশেষ ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যহাতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলার গারো পাহাড় এলাকায় হাতি কর্তৃক মানুষ মারা পড়েছে ৪৩ জন। এর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ১০ জন, জামালপুর জেলায় ৩ জন, নেত্রকোনা জেলায় ৫ জন এবং শেরপুর জেলায় সর্বোচ্চ ২৫ জন। অপরদিকে মানুষ কর্তৃক হাতি হত্যা হয়েছে জামালপুর জেলায় ৩টি, নেত্রকোনা জেলায় ২টি এবং সর্বোচ্চ শেরপুর জেলায় ২৭ টি হাতি। মানুষ মারা গেলে সরকার থেকে বন বিভাগের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। কিন্তু হাতি মারা গেলে বা হত্যা করা হলে এতদিন কোন আইনি ব্যবস্থাপন করা হয়নি। তবে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর শ্রীবরদী উপজেলায় এবং চলতি বছরের ১ নভেম্বর নালিতাবাড়ী উপজেলায় মাত্র দু’টি হাতি হত্যার অভিযোগে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৩৬(১)/ ৪১ ধারা অনুযায়ী পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে।
যেভাবে হাতি হত্যা চলছে তাতে দেশ থেকে এশিয়ান হাতির প্রজাতি শিগগিরই বিলুপ্তি হয়ে যেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন্যপ্রাণী গবেষকরা। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এমনটাই মনে করছেন তারাও। তবে আশার কথা শুনিয়েছেন শেরপুরের বন বিভাগ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ।
বন্য হাতির বৃদ্ধির বিষয়ে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ সুমন মিয়া বলেন, আমরা ইতিমধ্যে বন্যহাতি রক্ষা এবং মানুষের জানমাল ক্ষতি কমাতে স্থানীয় মানুষ এবং বন বিভাগ যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছি। সম্প্রতি কিছুদিন যাবত এই অঞ্চলে হাতি মানুষের অনেকটাই সহ অবস্থান ফিরে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বন অফিসের পাশেই একটি নতুন হাতের শাবক এর জন্ম হয়েছে। ওই হাতি শাবকটি এখন সুস্থ আছে এবং মা হাতিসহ হাতির দলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে শেরপুর বিভাগীয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম বলেন, শেরপুরে হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে সঠিক তথ্য। এখানের প্রতিটি দলেই বিভিন্ন বয়সের হাতির বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। গত দু’দিন আগে আমাদের ড্রোন ক্যামেরায় বনের ভিতর ৩৪ সদস্যের একটি হাতির দলে ৮ থেকে ১০ টি বাচ্চা দেখা গেছে। অর্থাৎ ২৪ টি হাতির সাথে ১০ টি হাতির বাচ্চা। এটি খুবই আশার কথা। আমাদের এই অঞ্চলে হাতির আবাসস্থল এবং খাদ্য সংকট কমে আসার কারণেই দিন দিন হাতের সংখ্যা বাড়ছে বলে আমরা মনে করি। যদিও চার বছর অন্তর হাতি প্রসব করেন। তিনি আরো বলেন, হাতি রক্ষায় আমরা ২০১৪ সাল থেকেই শেরপুরের তিনটি রেঞ্জ এলাকায় ৫০০ হেক্টর জমিতে হাতির খাদ্য বান্ধব গাছ রোপন করেছি।
তবে শেরপুরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রীন ভয়েস এর শেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মারুফুর রহমান জানায়, বিলুপ্তপ্রায় এই এশিয়ান প্রজাতির হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটি খুবই আশার কথা। তবে আগামী দিনগুলোতে জানমালের রক্ষার পাশাপাশি হাতি রক্ষা করতে স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের সুদৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
|| প্রকাশক ও সম্পাদক : আব্দুল্লাহ আল মামুন || নির্বাহী সম্পাদক : জি.এস জয় ||
Copyright © 2024 আমার প্রাণের বাংলাদেশ. All rights reserved.You cannot copy content of this page